সব
মানুষের জীবনে ইমান যেমন অপরিহার্য, তেমনি অপরিহার্য উত্তম চরিত্র। ইমান হৃদয়ের ভেতরের বিশ্বাসকে দৃঢ় করে, আর উত্তম চরিত্র সেই বিশ্বাসকে বাস্তবে প্রকাশ করে। চরিত্রই মানুষকে মহৎ করে, তাকে সমাজে মর্যাদাবান করে তোলে। একজন মানুষ যতই বিদ্বান বা ইবাদতকারী হোক না কেন, যদি তার আচার-আচরণে সৌন্দর্য না থাকে, যদি তার মধ্যে সহানুভূতি, ক্ষমাশীলতা ও ন্যায়পরায়ণতা না থাকে, তবে তার জ্ঞান ও ইবাদত কোনো উপকারে আসে না। ইসলাম তাই চরিত্র গঠনের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কেননা ইমান ও উত্তম চরিত্র মিলেই তৈরি করে পূর্ণাঙ্গ মুসলমান।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন উত্তম চরিত্রের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। মহান আল্লাহ তাকে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কলম ৪) তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত। শত্রুর প্রতি কোমলতা, অন্যায়ের জবাবে ন্যায়, কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্য, এ সবই তার চরিত্রের পরিচায়ক। তিনি শুধু নামাজ, রোজা, হজ বা জাকাতের শিক্ষা দেননি, শিখিয়েছেন মানুষ কেমন হবে, কেমন আচরণ করবে, কীভাবে কথা বলবে, কীভাবে অন্যের কষ্টে পাশে দাঁড়াবে।
মুখে হাসি রাখা, রাগ সংবরণ করা, কারও কষ্টে সহানুভূতিশীল থাকা, মন্দের জবাবে মন্দ না দিয়ে মঙ্গল করা, এসবই উত্তম চরিত্রের অংশ। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তুমি যেখানে থাকো আল্লাহকে ভয় করো, খারাপ কাজের পর ভালো কাজ করো, তা মন্দকে মুছে ফেলবে, আর মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো।’ (তিরমিজি ১৯৮৭) এ হাদিসে তিনি চরিত্রকে ইমানের পরই রেখেছেন, যেন বোঝানো যায়, চরিত্র ছাড়া ইমানের পূর্ণতা আসে না।
উত্তম চরিত্র মানবসমাজের প্রাণশক্তি। মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য, ভালোবাসা ও আস্থার বন্ধন তৈরি হয় চরিত্রের ভিত্তিতে। একজন সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি সমাজে আলো ছড়ায়, তার উপস্থিতি শান্তি আনে, তার মুখে হাসি অন্যের কষ্ট হালকা করে দেয়। সে মন্দের প্রতিশোধ নেয় না, বরং ক্ষমা করে। নিজের স্বার্থের আগে অন্যের মঙ্গলকে স্থান দেয়। এই চরিত্রই মানুষের হৃদয় জয় করে, শত্রুকে বন্ধুত্বে পরিণত করে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের পথে নিয়ে যায়।
ইমানের পাশাপাশি মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ উত্তম চরিত্র। এটি এমন একটি গুণ, যা মানুষের আচার-আচরণ ও অন্যদের প্রতি ব্যবহারের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে। উত্তম চরিত্র মানে হলো, মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করা, যেমন আচরণ আপনি নিজের জন্য কামনা করেন, যা শরিয়তসম্মত, ন্যায়সংগত ও সদ্ভাবপূর্ণ। এর মধ্যে আছে মুখে হাসি রাখা, কোমল ব্যবহার করা, মন্দের জবাবে ভালো ব্যবহার করা ইত্যাদি।
শায়খ ইবনু সাদি (রহ.) বলেছেন, উত্তম চরিত্র একটি মহান ও সম্মানিত গুণ। এর ভিত্তি হলো ধৈর্য, সহনশীলতা ও নৈতিকতার প্রতি আগ্রহ। এর ফল হলো অন্যদের প্রতি ক্ষমাশীলতা, কষ্টদাতাকে ক্ষমা করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় সৃষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত থাকা।
এসব গুণ মানুষের চারিত্রিক উৎকর্ষ বাড়িয়ে দেয়, মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের রাস্তা করে দেয়। মহান আল্লাহও তার বান্দাদের এসব গুণ অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করো, সত্য-সঠিক কাজের আদেশ দাও আর জাহিলদের এড়িয়ে চলো।’ (সুরা আরাফ ১৯৯)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের যে ব্যক্তির চরিত্র ও আচরণ সর্বোত্তম তোমাদের মধ্যে সেই আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয় এবং কিয়ামত দিবসেও আমার খুবই কাছে থাকবে।’ (তিরমিজি ২০১৮)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আবু দারদা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, সচ্চরিত্র ও সদাচারই দাঁড়িপাল্লার মধ্যে সবচেয়ে ভারী হবে। সচ্চরিত্রবান ও সদাচারী ব্যক্তি তার সদাচার ও চারিত্রিক মাধুর্য দ্বারা অবশ্যই রোজাদার ও নামাজির পর্যায়ে পৌঁছে যায়।’ (তিরমিজি ২০০৩)
আর দুনিয়াতে এই গুণের দ্বারা শত্রুরাও বন্ধু হয়ে যায়। মহান আল্লাহ এই চরিত্রকে সৌভাগ্যের চাবি আখ্যা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে প্রতিহত করো তা দ্বারা যা উৎকৃষ্টতর। ফলে তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা রয়েছে সে যেন হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এটি তারাই প্রাপ্ত হবে যারা ধৈর্যধারণ করবে, আর এর অধিকারী কেবল তারাই হয় যারা মহাভাগ্যবান।’ (সুরা ফুসসিলাত ৩৪-৩৫)
উত্তম চরিত্রের ফজিলত অনেক। আবু উমামাহ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ন্যায়সংগত হওয়া সত্ত্বেও ঝগড়া পরিহার করবে আমি তার জন্য জান্নাতের বেষ্টনীর মধ্যে একটি ঘরের জিম্মাদার। আর যে ব্যক্তি তামাশার ছলেও মিথ্যা বলে না আমি তার জন্য জান্নাতের মাঝখানে একটি ঘরের জিম্মাদার। আর যে ব্যক্তি তার চরিত্রকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে আমি তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থিত একটি ঘরের জিম্মাদার।’ (আবু দাউদ ৪৮০০)
অন্য হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, কোন কর্ম সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আল্লাহভীতি, সদাচার ও উত্তম চরিত্র। আবার তাকে প্রশ্ন করা হলো, কোন কাজটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, মুখ ও লজ্জাস্থান। (তিরমিজি ২০০৪)
উত্তম চরিত্রের অধিকারীরা শ্রেষ্ঠ মানুষ। মহানবী (সা.) বলতেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে নৈতিকতায় সর্বোত্তম।’ (সহিহ বুখারি ৩৫৫৯) এর মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসুলের ভালোবাসা লাভ করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর সৎকর্ম করো। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা ১৯৫)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে আমার প্রিয়তম এবং অবস্থানে আমার নিকটতম ব্যক্তিদের কিছু সেই লোক হবে যারা তোমাদের মধ্যে চরিত্রে শ্রেষ্ঠতম।’ (রিয়াজুস সালেহিন ১৭৪৭)
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ইমানে পরিপূর্ণ মুসলমান হচ্ছে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি।’ (তিরমিজি ১১৬২) মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মিজানের পাল্লায় সচ্চরিত্রের চেয়ে অধিক ভারী আর কিছুই নেই।’ (আবু দাউদ ৪৭৯৯)
লেখক : ইমাম ও মাদ্রাসাশিক্ষক